স্মরন গাথা
অরুণোদয় কুণ্ডু
“মেয়েটাকে ঘ্যাম দেখতে! রূপ যেন গলে গলে পরছে।কেমন নিষ্পাপ ভাবে নিচের দিকে
চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একে আগেতো কলেজে কখন দেখিনি! নতুন বোধ হয়। ইস, একে যদি পাওয়া
যেত। নাঃ যা করে হোগ আলাপটা করতেই হবে।” চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সুখেন যে
মেয়েটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল, সেদিকে তার খেয়াল নেই। খেয়াল হল, যখন
মেয়েটা হঠাৎ করে মুখ তোলায় চোখাচুখি হয়ে গেল।
“ধুর, এভাবে কাঁহাতক চুপচাপ দাঁড়ান যায়। এর মধ্যেই আবার জোরে বাথরুম পেয়েছে। বড়
জ্বালা! মেয়ে হয়ে জ্বালাটা আরও বেশী। লেডিস বাথরুমে যেতে আবার মাঠটা পেরিয়ে
ক্যান্টিনের কাছে যেতে হবে।” এসব মাথায় পাক খাওয়াতে খওয়াতেই উসখুস করছিল প্রথম
বর্ষের দৃষ্টি। কলেজে নতুন, তাই চোখ নামিয়েই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল সে। তবু
একটুক্ষণ হবার পর তার বিরক্ত লাগলো। চোখ তুলতেই দেখে উল্টোদিকের সারির একটা
ছেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ করে মাথায় রাগ উঠে গেল। কেমন
বেহায়ার মত দেখছে দ্যাখ। চোখটা একটু কটমট হবার আগেই একটা ভয় ওকে পেয়ে বসল;
“দেখে তো মনে হচ্ছে সিনিয়র, বেশি বাড়াবাড়ি করলে যদি......।” এসব ভেবে মুখটা
অন্য দিকে ঘোরাতেই একজোড়া কটমটে চোখের সামনে পড়ে গেল সে।
ছেলেমেয়েদের উপর নজর রাখছিলেন দিপেন বাবু। তার শরীরের ভাষাটাই কেমন রাগিরাগি,
মনটাও। “আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো সব উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কাউকে প্রাপ্য সন্মানটুকু
দিতে জানেনা। যে যার মত যেদিকে ইচ্ছা তাকিয়ে রয়েছে। ভেবেছিলেন নতুন
ছেলেপিলেগুলো হয়ত একটু ভদ্রসভ্য হবে। ও বাবা!! দেখা গেল ওই মেয়েটি সুখেনের দিকে
হাঁ করে তাকিয়ে আছে! আচ্ছা প্রেম করা ছাড়া কি এদের জীবনের কোন লক্ষ্য নেই?! তবু
ভাল তার চোখের সাথে চোখ পরতেই মেয়েটা নিজেকে সংযত করে নিয়েছে।” তিনি অন্য দিকে
মুখ ঘোরালেন। তারপরই এক ততোধিক বিরক্তিকর দৃশ্যের সন্মুখিন হতে হল তাঁকে।
“ঋজুটা চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল নাকিরে? টলছে মনে হচ্ছে যেন।” তমালকে ঠেলা দিয়ে
দেখায় নির্ভীক। পাস থেকে অসীম ফিসফিসিয়ে ফুট কাটে, “ব্যাটাকে বেশ যোগী যোগী
লাগছে! কি বলিস? দরদে তো ভেসে গেলরে”; তিনজনেই মুখটিপে হেসে ওঠে।
হাসিটা অট্টহাসিতে রূপান্তরিত হবার আগেই মুখ গম্ভির হয়ে গেল নির্ভীকের। দূর
থেকে তাদের হাসিটা দিপেন স্যারের চোখে পড়েছে। “লোকটা যেন কেমনতর। আরে বাবা তোর
সবেতে এত আপত্তি কিসের শুনি? তুই আমাদের মত বয়সে খুব নিয়ম মানতিস বুঝি! যত্তসব
ফাঁকা মাতব্বরি। এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড হয়েছে কিনা, তাই এত গরম! ফাঁকা কলসির
আওয়াজ একটু বেশীই হয়। যাহোগ এখন ছুপ করে থাকাই ভাল। কলেজ থেকে মার্কসগুলো
ইউনিভার্সিটির হাতে যাবার সময় এনার হাত দিয়েই যায়। তাই একে না ঘাঁটানোই ভাল।
পাস থেকে চাপা হাসির রোলটা এখনো আসছে। ওদের সাবধান করে দিতে হবে, কারন স্যার
দেখছেন। পাসে আড় চোখে তাকিয়েই সে হতবাক! অসীম হাত বাড়িয়েছে ঋজুর মাথার দিকে আর
স্যার একদৃষ্টে ওই দিকেই চেয়ে আছেন। “ওরে থাম! স্যার দেখছেন।” কিন্তু সবকটা কথা
তার মুখ থেকে বেরনোর আগেই একটা চাঁটি ঋজুর মাথায় গিয়ে পড়ল। চোখ খুলে এদিক ওদিক
তাকাল সে, কাউকেই তার ধ্যানভঙ্গের কারন হিসাবে শনাক্ত করতে না পেরে আবার চোখ
বুজল। কাল পি.কে. বলেছেন টেস্ট নেবে। কিছুই পড়া হয়নি তার। কিভাবে একদিনে সব শেষ
করবে সেই চিন্তায় সে আবার ডুবে গেল।
কয়েকফুট দূর থেকে ঋজুদের এইসব কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিল তন্ময়। আহারে, বেচারা
ঋজুটা শুধুমুধু চাঁটা খেয়ে গেল। একেবারে হ্যাবলা মার্কা ছেলে। কোন একটা
পারসোনালিটি নেই। যে যা বলে তাতেই হ্যা হ্যা করে। ধুত এদের দ্বারা কিসসু হবার
নয়। কিন্তু ছেলেটা এক্সাম গুলোয় মার্কস নেহাত খারাপ পায়না। ......হুঃ তার থেকে
তো আর বেশি পায়না। এবার আর কোন বাধা নেই। তাকে বাধা দেবার মত লোক আর কলেজে নেই।
এবার তার একছত্র আধিপত্য। মেয়েগুলোও এবার নোট নিতে তার কাছেই আসবে। সে দেবে।
তবে সহজে না। একটু ডাঁট দেখাতে না পারলে আর কি হল।
চনমন করে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বারবার ঘড়ি দেখে স্মৃতি। চারটেয় তার নাচের
ক্লাস। আগের দিন লেট হবার জন্য ম্যামের কাছে বকা খেয়েছে। আর আজ এখানেই হয়ে গেল
চারটে পাঁচ। কি যে বলবে না ম্যাম কে?! তিনিতো আর এসব শুনবেন না। “আমাকে কন
কৈফিয়ত দিতে এসোনা”, একথা বলে দিলে আর কিই বা বলা যায় তখন। “দুরসালা আমার কাছে
নস্ত করার মত সময় নেই” বলে উঠল তড়িৎ। ছুটে বেরিয়ে গেল মাথের দিকে। কারত ভাবে
সেদিকে চেয়ে রইল স্মৃতি। শেষ সারিতে থাকার জন্য ও বেরতে পারল। “ইস, আমি যদি
ওখানে থাকতাম”।
মাথা নিছু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অনিক। সামনে স্যারেরা ঘড়ি দেখাদেখি করেছেন।
কোন কাজ নিখুঁত ভাবে করতে এরা ভালবাসেন। হলেওবা টা লোকদেখানি কাজ। অবশ্য
লোকদেখানি কাজই সঠিক ভাবে করলে দেখার লোক মেলে। অনিকের মাথায় সেসব নেই। সে
ভাবছে, ‘আজ সকলেই প্রায় আছে। খালি অমর নেই। ছেলেটা সমসময় সবাইকে মাতিয়ে রাখত।
ওর সাথে অমরের সম্পর্কটা নিয়ে সবাই হিংসে করত। সবাই ওকে ভালও বাসত খুব। কিন্তু
তাও অমর চলে গেল। একবার বলেও গেলনা যে ো বাধা দেবে। আচ্ছা অমর তুই এটা...।”
“ থাঙ্ক ইউ।আপাতত এখানেই সমাপ্তি। আমাদের মেন বিল্ডিংএর ডাইনিং হলে অমরকে আনা
হয়েছে। যারা ইচ্ছুক ওখানে গিয়ে দেখে আসতে পার। ” প্রিন্সিপালের গমগমে গলায়
চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় অনিকের। নাঃ ও আর অমরের কাছে যাবেনা। ওই ট্রাকের তলায়
পড়া দোমড়ান পোস্টমর্টেম করা দেহটাকে সে আর দেখতে চায়না। আর কষ্ট পেতে চায়না সে।
নীরবতার শেষে সবাই তাদের ‘হৃদয় উজার’ করে অন্তিম ‘শুভেচ্ছা’ জানিয়েছে বন্ধুকে।
এখন সমবেত সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে নিজের নিজের প্রয়োজনে এগিয়ে চলেছে। অডিটোরিয়াম
প্রায় ফাঁকা। অনিক এগিয়ে আসে মঞ্চের দিকে। অমরের ছবির পাশে হতবম্ভের মত বসে
আছেন তার মা। ওনার নিরবতা পালন এখনো শেষ হয়নি। বোধ হয় শেষ হবেওনা। ওর অন্তরের
নিরবতা শেষ একদিন হয়ত চিতার আগুনে এসে মুক্ত হবে। “ চলুন কাকিমা আপনাকে বাড়ি
যেতে হবে”। কিছুটা স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে অনিকের দিকে তাকান তিনি। একটু দূরে কে
যেন মৃদুস্বরে বলে ওঠে, “আদিখ্যেতা”। মায়ের চোখের জল গাল বেয়ে নেমে আসে। তা
মেঝের স্পর্শ পায়। অনিকের দুফোঁটা চোখের জল তাতে এসে মেশে। গেট দিয়ে বেরোনোর
সময় স্নিগ্ধা অর্পণকে জিজ্ঞাস করে ওঠে, “হ্যাঁ রে, তার মানে কাল ছুটি তো?”